গনবার্তা

সুলতান শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহের ৬৭৫ বছরের সেই দুঃসাহসিক অভিযানের গল্প

বাঙালি জাতির নেপাল বিজয়

বাঙালি জাতির নেপাল বিজয়

নেপালের তরাই অঞ্চল। পাহাড় ছায়া, দুর্গম পথ আর কঠোর আবহাওয়া মিলিয়ে এমন এক এলাকা, যেখানে তৎকালীন ভারতের বা বাংলার কোনো মুসলিম সেনাবাহিনী আগে কখনও প্রবেশ করতে পারেনি। সময়টা ১৩৫০ সালের ২৭ নভেম্বর। আরবী নকশার ঘোড়ার মুখবন্ধ পরা একদল অশ্বারোহী ধুমধাড়াক্কা শব্দে এগিয়ে যাচ্ছে কাঠমাণ্ডুর দিকে। তাদের সামনে রয়েছেন বাংলার সুলতান—শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহ, এক দূরদর্শী সম্রাট, যিনি শুধু নতুন ভূখণ্ড জয় করতেই আসেননি; আসছেন বাঙালি জাতির পরিচয়কে নতুনভাবে নির্মাণ করতে।


স্বয়ম্ভুনাথের শিলালিপিতে অম্লান সেই আক্রমণ

ইতিহাসের পাতায় নেপাল অভিযান এক অলৌকিক ঘটনা। কাঠমাণ্ডুর নিকটবর্তী স্বয়ম্ভুনাথ মন্দিরে পাওয়া এক শিলালিপিতে উল্লেখ রয়েছে—৪৭০ নেওয়ারী সম্বৎ, অর্থাৎ ১৩৫০ খ্রিস্টাব্দে ‘পূর্ব দেশীয় সুলতান’ নেপালে প্রবেশ করেন এবং রাজধানী পর্যন্ত অগ্রসর হন। নেপালের রাজবংশীয় ইতিহাসেও এই আক্রমণের উল্লেখ রয়েছে।

সুলতান বিপুল ধনসম্পদ নিয়ে বাংলায় ফিরে আসেন। তা শুধু ধন-দৌলতই নয়—এ অভিযানে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ক্ষমতা, কৌশল আর বাঙালি অস্তিত্বের নতুন পরিচয়।


বিভক্ত জনপদ থেকে একীভূত ‘বাঙ্গালাহ’

ইলিয়াস শাহের কীর্তি কেবল নেপাল জয়ে সীমাবদ্ধ নয়। তিনি প্রথম শাসক যিনি লক্ষ্মণাবতী, সাতগাঁও/সপ্তগ্রাম ও সোনারগাঁও—এই তিনটি বিভক্ত বাংলা অঞ্চলে এক পতাকার নিচে একত্রিত করেন।

এর আগে বাংলা বিভিন্ন নামে পরিচিত ছিল—গৌড়, রাঢ়, সমতট, পুন্ড্রবর্ধন। ভাষা একই হলেও শাসন ছিল পৃথক। ইলিয়াস শাহ এসে প্রথম ঘোষণা করেন:
“এ ভূখণ্ডই বাঙ্গালাহ, আর এখানকার মানুষ বাঙালি।”

তারই হাত ধরে জন্ম নেয় রাজনৈতিকভাবে একীভূত প্রথম বাংলা রাষ্ট্র। সমগ্র অঞ্চলে ‘বাঙালি’ পরিচয়ের বীজ বপন হয়। পরবর্তী যুগে মুগলদের সুবাহ-ই-বাঙ্গালাহ, পর্তুগিজদের ‘বেঙ্গালা’, ইংরেজদের ‘বেঙ্গল’—সবই এই নামের ধারাবাহিকতা।


ক্ষমতায় ওঠার রোমাঞ্চকর পথ

ইলিয়াস শাহ ছিলেন পারস্যের সিজিস্তানের অধিবাসী। কিশোর বয়সে একটি অপরাধের দায়ে দিল্লি থেকে পালিয়ে এসে সাতগাঁওয়ে আশ্রয় নেন। অল্পদিনেই শাসক ইজ্জুদ্দীন ইয়াহইয়ার কাছ থেকে মালিক উপাধি পান। এরপর ১৩৩৮ সালে সাতগাঁওয়ের শাসক এবং ১৩৪২ সালে পুরো বাংলার সুলতান।

সিংহাসনে বসেই রাজধানী গৌড় থেকে পান্ডুয়ায় স্থানান্তর করেন। দ্রুতই পান্ডুয়া হয়ে ওঠে বাংলার এক প্রধান নগরী।


উড়িষ্যা থেকে বেনারস—সাম্রাজ্যের বিস্তার

ইলিয়াস শাহ ছিলেন বাংলার প্রথম ‘দূরদর্শী সামরিক কৌশলী’। তার কর্মকাণ্ডে দেখা যায় পরিকল্পনা, গতি ও বিচক্ষণতা।

তার প্রধান অভিযানগুলো—

  • ১৩৪৪: ত্রিহুত দখল

  • ১৩৫০: নেপাল অভিযান

  • ১৩৫২: সোনারগাঁও জয়—সমগ্র বাংলা একীভূত

  • ১৩৫৩: বিহার দখল

  • এরপর বেনারস, গোরখপুর, চম্পারন পর্যন্ত অগ্রসর

  • ১৩৫৭: কামরূপ জয়

একদিকে উড়িষ্যা উপকূল, অন্যদিকে নেপালের পাদদেশ, আবার উত্তরে হিমালয় সংলগ্ন জনপদ—এসবই ইলিয়াস শাহের কর্তৃত্বাধীন অঞ্চলের অংশ হয়ে ওঠে।


দিল্লির সঙ্গে সংঘাত: কূটনীতির অনন্য উদাহরণ

বাংলার উত্থান দিল্লির তুঘলক শাসক ফিরোজ শাহ তুঘলককে বিচলিত করেছিল। তিনি বাংলায় সামরিক অভিযান চালালে ইলিয়াস শাহ সরাসরি মোকাবিলা না করে কৌশলগত অপেক্ষা করেন। নদী-নালা পরিবেষ্টিত বাংলার ভৌগোলিক সুবিধা কাজে লাগিয়ে সংঘর্ষ এড়িয়ে তিনি বাংলার স্বাধীনতা রক্ষা করেন।

এ ছিল মধ্যযুগীয় কূটনীতির এক নিখুঁত উদাহরণ।


সুশাসন ও জনশক্তির উত্থান

ইলিয়াস শাহের প্রশাসনের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য—
তিনি শাসনব্যবস্থাকে স্থানীয় মানুষের হাতে তুলে দেন।

  • বাংলার সাধারণ মানুষকে বৃহৎ পরিসরে সেনাবাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করেন

  • করব্যবস্থা সহজ করেন

  • পান্ডুয়া ও গৌড়ে বাণিজ্য সম্প্রসারণ ঘটান

  • রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করেন

এই সময়ে বাংলায় শান্তি, বাণিজ্য ও কৃষিতে অভূতপূর্ব উন্নয়ন ঘটে।


কেন ইলিয়াস শাহকে ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদের জনক’ বলা হয়?

জিয়াউদ্দীন বারানী প্রথম বাংলাকে উল্লেখ করেন ইকলিম-ই-বাঙ্গালাহ নামে। পরবর্তীতে শামস-ই-সিরাজ তাকে আখ্যা দেন—

  • ‘সুলতান-ই-বাঙ্গালাহ’

  • ‘শাহ-ই-বাঙালিয়ান’

তারই সময়ে বাংলা প্রথম একটি একীভূত সত্তায় রূপ নেয়, যার ভিত্তিতে গড়ে ওঠে পরবর্তী ৬০০ বছরের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিচয়—বাঙালিত্ব

ইলিয়াস শাহের হাতে প্রতিষ্ঠিত এই স্বাধীন সালতানাত প্রায় দুই শতাব্দী টিকে ছিল—যা বাংলার রাষ্ট্রীয় ইতিহাসে এক বড় ভিত্তি।


৬৭৫ বছর পরও যে ইতিহাস অনুপ্রেরণা দেয়

১৩৫০ সালের সেই নেপাল অভিযান শুধু সামরিক সাফল্য ছিল না—এ ছিল বাঙালি জাতির আত্মপরিচয় খুঁজে পাওয়ার এক মোড় ঘোরানো মুহূর্ত।
জাতিগত, ভৌগোলিক ও প্রশাসনিক দিক থেকে বাঙালিত্বের যে ভিত্তি আমরা আজ দেখি, তার বীজ রোপণ করেছিলেন সুলতান শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহ।

তার বিজয়ের ৬৭৫তম বর্ষে আমরা শুধু ইতিহাস স্মরণ করি না—
সেই সাহস, দূরদর্শিতা ও জাতি গঠনের ঐতিহ্যকেও শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি।

আপনার মতামত লিখুন

গনবার্তা

বৃহস্পতিবার, ২৭ নভেম্বর ২০২৫


বাঙালি জাতির নেপাল বিজয়

প্রকাশের তারিখ : ২৭ নভেম্বর ২০২৫

featured Image
নেপালের তরাই অঞ্চল। পাহাড় ছায়া, দুর্গম পথ আর কঠোর আবহাওয়া মিলিয়ে এমন এক এলাকা, যেখানে তৎকালীন ভারতের বা বাংলার কোনো মুসলিম সেনাবাহিনী আগে কখনও প্রবেশ করতে পারেনি। সময়টা ১৩৫০ সালের ২৭ নভেম্বর। আরবী নকশার ঘোড়ার মুখবন্ধ পরা একদল অশ্বারোহী ধুমধাড়াক্কা শব্দে এগিয়ে যাচ্ছে কাঠমাণ্ডুর দিকে। তাদের সামনে রয়েছেন বাংলার সুলতান—শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহ, এক দূরদর্শী সম্রাট, যিনি শুধু নতুন ভূখণ্ড জয় করতেই আসেননি; আসছেন বাঙালি জাতির পরিচয়কে নতুনভাবে নির্মাণ করতে। স্বয়ম্ভুনাথের শিলালিপিতে অম্লান সেই আক্রমণ ইতিহাসের পাতায় নেপাল অভিযান এক অলৌকিক ঘটনা। কাঠমাণ্ডুর নিকটবর্তী স্বয়ম্ভুনাথ মন্দিরে পাওয়া এক শিলালিপিতে উল্লেখ রয়েছে—৪৭০ নেওয়ারী সম্বৎ, অর্থাৎ ১৩৫০ খ্রিস্টাব্দে ‘পূর্ব দেশীয় সুলতান’ নেপালে প্রবেশ করেন এবং রাজধানী পর্যন্ত অগ্রসর হন। নেপালের রাজবংশীয় ইতিহাসেও এই আক্রমণের উল্লেখ রয়েছে। সুলতান বিপুল ধনসম্পদ নিয়ে বাংলায় ফিরে আসেন। তা শুধু ধন-দৌলতই নয়—এ অভিযানে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ক্ষমতা, কৌশল আর বাঙালি অস্তিত্বের নতুন পরিচয়। বিভক্ত জনপদ থেকে একীভূত ‘বাঙ্গালাহ’ ইলিয়াস শাহের কীর্তি কেবল নেপাল জয়ে সীমাবদ্ধ নয়। তিনি প্রথম শাসক যিনি লক্ষ্মণাবতী, সাতগাঁও/সপ্তগ্রাম ও সোনারগাঁও—এই তিনটি বিভক্ত বাংলা অঞ্চলে এক পতাকার নিচে একত্রিত করেন। এর আগে বাংলা বিভিন্ন নামে পরিচিত ছিল—গৌড়, রাঢ়, সমতট, পুন্ড্রবর্ধন। ভাষা একই হলেও শাসন ছিল পৃথক। ইলিয়াস শাহ এসে প্রথম ঘোষণা করেন: “এ ভূখণ্ডই বাঙ্গালাহ, আর এখানকার মানুষ বাঙালি।” তারই হাত ধরে জন্ম নেয় রাজনৈতিকভাবে একীভূত প্রথম বাংলা রাষ্ট্র। সমগ্র অঞ্চলে ‘বাঙালি’ পরিচয়ের বীজ বপন হয়। পরবর্তী যুগে মুগলদের সুবাহ-ই-বাঙ্গালাহ, পর্তুগিজদের ‘বেঙ্গালা’, ইংরেজদের ‘বেঙ্গল’—সবই এই নামের ধারাবাহিকতা। ক্ষমতায় ওঠার রোমাঞ্চকর পথ ইলিয়াস শাহ ছিলেন পারস্যের সিজিস্তানের অধিবাসী। কিশোর বয়সে একটি অপরাধের দায়ে দিল্লি থেকে পালিয়ে এসে সাতগাঁওয়ে আশ্রয় নেন। অল্পদিনেই শাসক ইজ্জুদ্দীন ইয়াহইয়ার কাছ থেকে মালিক উপাধি পান। এরপর ১৩৩৮ সালে সাতগাঁওয়ের শাসক এবং ১৩৪২ সালে পুরো বাংলার সুলতান। সিংহাসনে বসেই রাজধানী গৌড় থেকে পান্ডুয়ায় স্থানান্তর করেন। দ্রুতই পান্ডুয়া হয়ে ওঠে বাংলার এক প্রধান নগরী। উড়িষ্যা থেকে বেনারস—সাম্রাজ্যের বিস্তার ইলিয়াস শাহ ছিলেন বাংলার প্রথম ‘দূরদর্শী সামরিক কৌশলী’। তার কর্মকাণ্ডে দেখা যায় পরিকল্পনা, গতি ও বিচক্ষণতা। তার প্রধান অভিযানগুলো— ১৩৪৪: ত্রিহুত দখল ১৩৫০: নেপাল অভিযান ১৩৫২: সোনারগাঁও জয়—সমগ্র বাংলা একীভূত ১৩৫৩: বিহার দখল এরপর বেনারস, গোরখপুর, চম্পারন পর্যন্ত অগ্রসর ১৩৫৭: কামরূপ জয় একদিকে উড়িষ্যা উপকূল, অন্যদিকে নেপালের পাদদেশ, আবার উত্তরে হিমালয় সংলগ্ন জনপদ—এসবই ইলিয়াস শাহের কর্তৃত্বাধীন অঞ্চলের অংশ হয়ে ওঠে। দিল্লির সঙ্গে সংঘাত: কূটনীতির অনন্য উদাহরণ বাংলার উত্থান দিল্লির তুঘলক শাসক ফিরোজ শাহ তুঘলককে বিচলিত করেছিল। তিনি বাংলায় সামরিক অভিযান চালালে ইলিয়াস শাহ সরাসরি মোকাবিলা না করে কৌশলগত অপেক্ষা করেন। নদী-নালা পরিবেষ্টিত বাংলার ভৌগোলিক সুবিধা কাজে লাগিয়ে সংঘর্ষ এড়িয়ে তিনি বাংলার স্বাধীনতা রক্ষা করেন। এ ছিল মধ্যযুগীয় কূটনীতির এক নিখুঁত উদাহরণ। সুশাসন ও জনশক্তির উত্থান ইলিয়াস শাহের প্রশাসনের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য— তিনি শাসনব্যবস্থাকে স্থানীয় মানুষের হাতে তুলে দেন। বাংলার সাধারণ মানুষকে বৃহৎ পরিসরে সেনাবাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করেন করব্যবস্থা সহজ করেন পান্ডুয়া ও গৌড়ে বাণিজ্য সম্প্রসারণ ঘটান রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করেন এই সময়ে বাংলায় শান্তি, বাণিজ্য ও কৃষিতে অভূতপূর্ব উন্নয়ন ঘটে। কেন ইলিয়াস শাহকে ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদের জনক’ বলা হয়? জিয়াউদ্দীন বারানী প্রথম বাংলাকে উল্লেখ করেন ইকলিম-ই-বাঙ্গালাহ নামে। পরবর্তীতে শামস-ই-সিরাজ তাকে আখ্যা দেন— ‘সুলতান-ই-বাঙ্গালাহ’ ‘শাহ-ই-বাঙালিয়ান’ তারই সময়ে বাংলা প্রথম একটি একীভূত সত্তায় রূপ নেয়, যার ভিত্তিতে গড়ে ওঠে পরবর্তী ৬০০ বছরের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিচয়—বাঙালিত্ব। ইলিয়াস শাহের হাতে প্রতিষ্ঠিত এই স্বাধীন সালতানাত প্রায় দুই শতাব্দী টিকে ছিল—যা বাংলার রাষ্ট্রীয় ইতিহাসে এক বড় ভিত্তি। ৬৭৫ বছর পরও যে ইতিহাস অনুপ্রেরণা দেয় ১৩৫০ সালের সেই নেপাল অভিযান শুধু সামরিক সাফল্য ছিল না—এ ছিল বাঙালি জাতির আত্মপরিচয় খুঁজে পাওয়ার এক মোড় ঘোরানো মুহূর্ত। জাতিগত, ভৌগোলিক ও প্রশাসনিক দিক থেকে বাঙালিত্বের যে ভিত্তি আমরা আজ দেখি, তার বীজ রোপণ করেছিলেন সুলতান শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহ। তার বিজয়ের ৬৭৫তম বর্ষে আমরা শুধু ইতিহাস স্মরণ করি না— সেই সাহস, দূরদর্শিতা ও জাতি গঠনের ঐতিহ্যকেও শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি।

গনবার্তা

সম্পাদকঃ নূর মোহাম্মদ 
প্রকাশকঃ ফিরোজ আল-মামুন 

কপিরাইট © ২০২৫ সর্বস্ব সংরক্ষিত গনবার্তা